এক বছর পূর্তি, আস্থার প্রতিদান দিতে হবে বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে

Passenger Voice    |    ০৮:৫১ এএম, ২০২১-০৬-২২


এক বছর পূর্তি, আস্থার প্রতিদান দিতে হবে বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে

সামসুদ্দীন চৌধুরীঃ  বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর উন্নয়নে সব সেবা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের কাজটি চেয়ারম্যানকে করতে হবে। একই সঙ্গে মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। গত এক বছরে বিআরটিএতে দালাল নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছেন। ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরিস্থিতির উন্নতি না হলেও বিআরটিএর সচ্ছতা ও দুর্নীতি বন্ধসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান। এ কারণে বিআরটিএর সেবা প্রত্যাশাকারীদের মধ্যে আশা ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষের এই আস্থার প্রতিদান দিতে হবে বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে। 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার এর দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে প্যাসেঞ্জার ভয়েসের বিশেষ প্রতিবেদনে বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান এর এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ নিয়ে পাঠকের মতামত নেয়া হয়েছে।  গত বছরের ২২ জুন বিআরটিএর চেয়ারম্যান এর দায়িত্ব পেয়েছেন নুর মোহাম্মদ মজুমদার। 

বিআরটিএর চেয়ারম্যান এর এক বছরের কাজের মূল্যায়ন করে বিশিষ্টজনেরা বলেন, গত এক বছরে চেয়ারম্যানকে সক্রিয় মনে হয়েছে। এতে করে তাঁর প্রতি বিআরটিএর সেবা প্রত্যাশিদের আস্থা তৈরি হয়েছে। তবে চেয়ারম্যান এই আস্থার প্রতিদান দিতে না পারলে জনগণের আশাভঙ্গ হবে।

ড্রাইভিং লাইসেন্সে ভোগান্তিঃ

ড্রাইভিং লাইসেন্স কেলেঙ্কারি থেকে বিআরটিএ প্রতি জনগণের আস্থা ফেরাতে ইতিমধ্যে পরিবর্তন হয়েছে বিআরটিএর তিন জন চেয়ারম্যান। বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার যোগদানের পর ড্রাইভিং লাইসেন্সের গতি ফেরাতে ২০২০ সালের ২৯ জুলাই ভারতীয় কোম্পানি মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে পাঁচ বছরে ৪০ লাখ স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহের শতকোটি টাকার চুক্তি সই করে বিআরটিএ। এ চুক্তিতে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের বাংলাদেশি এজেন্ট লজিক ফোরাম। চুক্তি অনুসারে ২০২০ সালের ২৯ জুলাই থেকে দুই মাসের মধ্যে প্রিন্ট করা স্মার্ট লাইসেন্স কার্ড সরবরাহ করার কথা। করোনা পরিস্থিতির কারণে সেই সময় বাড়িয়ে সাড়ে চার মাস করা হয়। সে হিসাবে গত ডিসেম্বর থেকে প্রিন্ট করা স্মার্ট লাইসেন্স কার্ড সরবরাহ করার কথা মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের। কিন্তু এক বছরেও বিআরটিএকে সময়মতো স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স সরবরাহ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠান। এমনকি ড্রাইভিং লাইসেন্সের নমুনাও দেখাতে পারেনি তারা।

পরীক্ষায় পাস করেও ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছেন না ১৫ লাখ মানুষ। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন দেশে-বিদেশে চালক পদে চাকরিপ্রত্যাশীরা। মধ্যপ্রাচ্যে নিশ্চিত হওয়া চাকরি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ড না পাওয়ায়। মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের কারণেই এই ভয়াবহ ভোগান্তি। চুক্তি হলেও এক বছরেও বিআরটিএ স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স সরবরাহ করতে পারছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বিআরটিএ।

বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের ব্যর্থতার কারণে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে না পারায় বিআরটিএর সব অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এর কারণে দুই বছর ধরে বাংলাদেশ দক্ষ চালক রপ্তানিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে অন্যান্য দেশ সে স্থান দখল করে নিচ্ছে। এরইমধ্যে আজ বিদায় নিচ্ছে এত ড্রাইভিং লাইসেন্স স্মার্ট কার্ড সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি।

ড্রাইভিং লাইসেন্সের এমন অবস্থা নিয়ে বিশিষ্টজনরা বলছে, ড্রাইভিং লাইসেন্সের ভোগান্তি দূর করতে হলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান কে আরো কৌশলী হতে হবে।  মাদ্রাজ সিকিউরিটিস ফিন্টার্সের সাথে চুক্তি করা ৪০ লাখ লাইসেন্স এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি কাজ শুরু করার সাথে সাথে পূর্বের সরবরাহ না হওয়া ১৫ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করতে হবে যা গত ২ বছরে বিআরটিএ প্রদান করতে পারেনি। ১৫ লাখ স্মার্ট কার্ড প্রদানের পরে আগামী ৫ বছর বাকী ২৫ লাখ কার্ড দিয়ে বিআরটিএ কিভাবে চলবে তাও চিন্তার বিষয়। কার্ড সরবরাহ না থাকার পরেও ২ বছরে ১৫ লাখ মানুষ ড্রাইভিং লাইসেন্সের সকল প্রক্রিয়া শেষ করেছে। কার্ড সরবরাহ শুরু হলে বছরে আনুমানিক ১০ লাখ চালক ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রত্যাশী থাকবে। তাহলে আগামী ৫ বছরে আরো ৫০ লাখ স্মার্ট কার্ড প্রয়োজন হতে পারে। আগামীতে যে বিআরটিএতে আবারও এই ভোগান্তি না হয় সেই বিষয়টি মাথায় রেখে ৪০ লাখ কার্ড সরবরাহ করার পরে বিআরটিএ কি করবে সে বিষয়টিও বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নিয়ে গুছিয়ে দিলে জনগণের ভোগান্তি শেষ হবে। 

বাণিজ্যিক গাড়ির মেয়াদ নির্ধারনে বর্তমান চেয়ারম্যান এর উদ্যোগঃ

উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটির সুপারিশের দুই বছরেরও বেশি সময় পর, বাস ও ট্রাকসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক যানবাহনের সার্ভিস চালিয়ে যাওয়ার মেয়াদ নির্ধারণ করে দিতে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার কিছুদিন আগে পরিবহন বিশেষজ্ঞ, পরিবহন নেতা, যানবাহন প্রস্তুতকারক ও আমদানিকারকসহ সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠকে বসেছেন।

বর্তমানে দেশে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত বাহনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ নির্ধারণ করে দেওয়া নেই। এ সুযোগে সড়কে  কয়েক দশকের পুরনো বাস ও ট্রাকও চলছে। ২০১০ সালে পরিবহন কর্তৃপক্ষ রাজধানীতে ২০ বছরের বেশি পুরনো বাস এবং ২৫ বছরের বেশি পুরনো পণ্যবাহী পরিবহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু, এমন অনেক পুরনো যানবাহনই জেলা পর্যায়ে চলাচল করছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। পরিবেশ দূষণও ঘটছে।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার কমিটির সুপারিশের সঙ্গে মিল রেখে বাণিজ্যিক যানবাহনের আর্থিক সেবার মেয়াদ নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। 

পুরনো যানবাহনকে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়, একদিকে এ জাতীয় যানবাহন, বিশেষ করে পুরনো বাস ও ট্রাক, রাস্তায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ফলে যানজটের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে, এগুলো দুর্ঘটনা ও প্রাণহানিরও কারণ। মেয়াদের ওপর নির্ভর করে এসব যানবাহনের চেসিস, ব্রেক সিস্টেম ও অ্যাক্সেল দুর্বল হয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়। পাশাপাশি, এসব যানবাহন থেকে কার্বন ডাই অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস বেশি নির্গত হওয়ায় পরিবেশ দূষিত হয়।

সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে পুরানো গাড়ি থেকে নির্গত ক্ষতিকর গ্যাস রাজধানীর ১৫ শতাংশ বায়ু দূষণের জন্য দায়ী করেছেন।

অবকাঠামোগত পরিবর্তন হয়নিঃ 

২৭ টি জেলা থেকে ইতিমধ্যে বিআরটিএর স্থায়ী ভবন নির্মাণের সুপারিশ পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসকরা। তবে এই ধরনের কার্যক্রমের তেমন কোন উন্নতি হয়নি। বিআরটিএ জেলা সার্কেল গুলোতে নিজস্ব ভবন নির্মাণ করলে বিআরটিএর বিভিন্ন অনিয়ম বন্ধ করা যাবে। ভিআইসির মাধ্যমে গাড়ির ফিটনেস পদ্ধতি ডিজিটাল করা যাবে। এতে চোখে দেখা ফিটনেস প্রদান বন্ধ হবে বিআরটিএতে। সড়ক দুর্ঘটনা কমবে, মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কর ঝক্কর গাড়ি ফিটনেস গ্রহন করতে পারবে না। ফলে সরকারের চাওয়া যানবাহনের ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ প্রক্রিয়াও সুফল আসবে বলে মন্তব্য করেন অনেকে। 

যানবাহনের ফিটনেস সনদ নবায়নে অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট চালুঃ 

যানবাহনের ফিটনেস সনদ নবায়নে অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বর্তমান চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি যোগদানের পরে এ সংক্রান্ত একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বিআরটিএ। বিআরটিএর ওই গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মূল্যবান সময় বাঁচান, অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ফিটনেস সনদ গ্রহণ করুন। গতবছরের ১৫ অক্টোবর থেকে এ পদ্ধতিতে ফিটনেস নবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ঢাকার তিনটি মেট্রো সার্কেল, মিরপুর, ইকুরিয়া ও দিয়াবাড়ি থেকে এ সনদ নেওয়া যাচ্ছে। সারাদেশের বিআরটিএর কার্যালয়ে এ পদ্ধতিতে ফিটনেস সনদ নবায়ন কার্যক্রম চালু করাও চেষ্টা করছেন তিনি। এছাড়া বিআরটিএর নিবন্ধিত গাড়ি বিআরটিএর যে কোন সার্কেলে ফিটনেস করার সুযোগও তিনি করছেন দায়িত্ব নেয়ার পরে।

ড্রাইভিং লাইসেন্সের সফটওয়্যার গত সমস্যা নিরসন করতে পারেননি বর্তমান চেয়ারম্যানঃ 

গতবছর খানেক আগে মাঝারি ও ভারি যান চালনায় চালকের সংকট লক্ষ্য করে বিআরটিএ ১ বছর মেয়াদি হালকা যানের চালককে মাঝারি লাইসেন্স ও ১ বছর মাঝারি যান চালককে ভারি যান চালানোর লাইসেন্স, ও তিন বছর হালকা যান চালানো চালককে সরাসরি ভারি লাইসেন্স দেয়ার সুযোগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বিআরটিএ। তবে বিএসপি সফটওয়্যার থেকে শিক্ষানবিশ লাইসেন্স ইস্যু হলেও পরীক্ষায় পাস করে ভারি লাইসেন্স পাচ্ছে না তারা। মাঠ পর্যায়ের বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছে BRTA IS সফটওয়্যারে এখনও সিস্টেম আপডেট হয়নি তাই তারা গ্রাহককে এই সংক্রান্ত সেবা দিতে পাচ্ছে না। বিআরটিএর সদর দপ্তরের কাছে বারবার যোগাযোগ করেও কোন সুফল মিলছে না। 

মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে কব্জির জোরে বিআরটিএতে বদলী বন্ধ করেছে নুর মোহাম্মদ মজুমদারঃ

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর কর্মকর্তাদের বদলী ও পদায়ন নিয়ে খোদ বিআরটিএর প্রশাসন বিভাগের অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়গুলো আলোচিত ছিল। বর্তমান চেয়ারম্যান যোগদানের পরে বদলী বাণিজ্য,  কব্জির জোরে পছন্দের সার্কেলে বদলী হওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করেন তিনি।  সাম্প্রতিক সময়ে বিআরটিএর বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতি, জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জনসহ বেশ কিছু অভিযোগ নিয়ে কয়েকজন কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলী করেছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। তবে এই বদলী ও পদায়নে কতিপয় কর্মকর্তাকে বিভিন্ন সার্কেলে বদলী করা হলেও অনেক কর্মকর্তা বদলীকৃত স্থানে যোগদান না করে কব্জির জোড়ে তাদের পছন্দের স্থানে বদলী হওয়ায় অভিযোগ উঠেছে। বিআরটিএর কর্মকর্তাদের বদলী ও পদায়নের ক্ষেত্রে সরকার ২০১৮ সালে ক, খ, গ, ঘ ক্যাটাগড়ি নির্ধারণ করে একটি নীতিমালা গঠন করে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছিল। তবে সেই নীতিমালা না মানার বিষয়ে খোধ অভিযোগ বিআরটিএ প্রশাসন বিভাগের দিকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করে নুর মোহাম্মদ মজুমদার এর সচ্ছতা জবাবদিহিতার কারনে এই বদলী অনিয়ম বন্ধ হবে বিআরটিএতে।